Advertisement

Tuesday, April 5, 2016

8:39 PM
আমার একজন বয়স্কা কাজের বুয়া ছিল। মুখ ভরা
জল বসন্তের দাগ, একটা পা নষ্ট। সেই নষ্ট পা
নিয়ে খুব কষ্ট করে টেনে টেনে হাঁটতেন। একটি
মানুষের জীবনে যে কত বিপর্যয় আসতে পারে, সেই
ভদ্রমহিলা ছিলেন তাঁর উদাহরণ। তাঁর বাবা ছিল
পাকিস্তানী, মা নোয়াখালীর। ৭১ এর স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় তাঁর বাবা মা আর তাঁকে ফেলে
পালিয়ে যায় নিজের দেশে। মায়ের আবার বিয়ে
হয় যুদ্ধের পর। সৎ পিতার ঘরে অবর্ণনীয় নির্যাতন
সয়ে তাঁর বিয়ে হয় এক সময়।
তবে হ্যাঁ, মুখে জল বসন্তের দাগ আর নষ্ট পা নিয়ে
এই দেশে একটি মেয়ের যেমন বিয়ে হতে পারে,
ঠিক তেমনই বিয়ে হয়। মায়ের বাড়ি থেকেও
অবর্ণনীয় নির্যাতন সইতে হতো শ্বশুরবাড়িতে।
ই বুয়ার মুখে শুনেছিলাম, প্রায়ই বলতেন তিনি
কথাটা-
“পুরুষ মানুষ জিদ করলে হয় বাদশা
মেয়ে মানুষ জিদ করলে হয় বেশ্যা!”
সে সময় কথাটা শুনে মনে মনে হাসতাম। একজন
অশিক্ষিত নারীর সাথে তর্ক করতে মন চাইত না।
তবে যত বয়স বেড়েছে, বুঝতে শিখেছি যে কথাটা
আসলে মিথ্যা নয়। বরং কথাটা সত্যি। ভীষণ ভাবে
সত্যি। জেদ করা মেয়ে মানুষকে এই সমাজ বেশ্যাই
বলে। পান থেকে চুন খসলেও যে সমাজে মেয়েদের
কলঙ্কিনী আখ্যা দিয়ে দেয়া হয়, সেই সমাজে
জেদ করলে মেয়েকে বেশ্যা তো বলতেই হবে।
মেয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশায় যেতে চাইল? মেয়ে
উড়নচণ্ডী, মেয়ের চরিত্র খারাপ। মেয়ে মা বাবার
পছন্দে বিয়ে করবে না? মেয়ের চরিত্র খারাপ
বলেই তো এই অবস্থা। বরের অঢেল টাকা থাকা
সত্ত্বেও মেয়ে চাকরি করবে? আরে, কোন চরিত্র
ভালো মা-বউ কি চাকরি করে! মেয়ে এখনই সন্তান
চায় না? চরিত্র খারাপ, আরও পুরুষের সাথে
ঢলাঢলি করতে চায়। স্বামীর চাইতে উচ্চশিক্ষিত
হতে চায় মেয়ে? চরিত্র ভালো হলে তো স্বামীর
চাইতে বড় হতে চাইত না। মেয়ের স্বামী পরকীয়া
করে? মেয়ের চরিত্র খারাপ বলেই তো স্বামী
অন্যদিকে তাকায়। মেয়ে কর্মজীবনে সফল? ওই
তো, চরিত্র খারাপ। বসেদের সাথে ঢলাঢলি করে
সফল হয়েছে। মেয়ে তালাক চায়? সর্বনাশ! এই
মেয়ের চরিত্র তো অবশ্যই অবশ্যই খারাপ। স্বামী
হচ্ছে সোনার চামচ। সোনার চামচ বাঁকাও ভালো।
সেই সোনার চামচ থেকেও কি তালাক নেয়া
সম্ভব? স্বামী তালাক দেবে, মেয়ে কাঁদবে আর
পায়ে ধরবে যেন তালাক না দেয়। সেই মেয়ে যদি
নিজেই তালাক দেয়ার জেদ করে, তবে কি মেয়ের
চরিত্র খারাপ না? তবে কি মেয়ে বেশ্যা না?
দ্বিতীয় বিয়ে করা মেয়ে মানুষ নিয়ে বলার কিছুই
নেই। দ্বিতীয় বিয়ে হলো মানে মেয়ে
নিঃসন্দেহে বেশ্যা। এই মেয়ে এখন সকলের
ভোগের বস্তু! যার ইচ্ছা যাও, গিয়ে ফুর্তি করে
ছেড়ে দাও। যে মেয়ে দুই স্বামীর সাথে শুতে
পারে, সে ১০ পুরুষের সাথে শুলেই বা কি!
হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে আমাদের সমাজের মনোভাব। এবং
না, এই কথাগুলো আমার না। কথাগুলো বলছিল
আমার সামনে বসে থাকা মেয়েটি। ফেসবুকে
অনেকদিন ধরেই পরিচয়, সেখান থেকে বাস্তবে
বন্ধুত্ব। আমার চাইতে বয়সে বেশ খানিকটা ছোট।
এরই মাঝে জীবনে অনেক খানি ঝড়ঝাপটা বয়ে
গেছে। খুব ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল, স্বামী
বেকার আর মদ্যপ। তা হলেও হয়তো চলতো, তবে
সেই সাথে চরিত্রহীনও বটে। স্বামী আর
শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সয়েও কিশোরী মেয়েটি
ধুঁকে ধুঁকে দিন পার করছিল।
কিশোরী একদিন তরুণী হলো আর তরুণী একদিন
জেদ ধরলো- তাঁর তালাক চাই। তাঁর সন্তান বা
সংসার চাই না, তাঁর তালাক চাই। এই স্বামী ও এই
শ্বশুর বাড়ির হাত থেকে তাঁর মুক্তি চাই।
সমাজের কথা বাদ দিন, মেয়ের নিজের আপন
পরিবার পর্যন্ত শত্রু শিবিরে যুক্ত হলো। পারলে
এমন মেয়েকে মুখে লবণ ঠেসে গলা টিপে মেরে
ফেলে। বিয়ের এত বছর বাদে তালাক? তাও নিজে
তালাক দেবে স্বামীকে। এও কি সম্ভব? শ্বশুরবাড়ি
তেড়ে এলো, নিজের পরিবার ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর
বদলে সেই আগুনে উল্টো ধাক্কা দিয়ে ফেলে
দিল, বন্ধু বান্ধবের দল মুখ ফিরিয়ে নিল, বিশাল এই
পৃথিবীতে মেয়েটি তখন একা। সকলের একই কথা,
তালাকের জেদ ছেড়ে দাও। স্বামী যেমনই হোক
তাঁকে মেনে নাও।
না, মেয়ে নিল না। সে স্রোতের বিপরীতে
দাঁড়িয়ে সেই স্বামী পুরুষকে তালাক অবশ্যই
দিলো। একলা হয়ে গেল পৃথিবীতে। মা বাবার ঘরে
জায়গা হলো না, গিয়ে সাবলেট উঠলো। চাকরি
ছিল, সেটাকেই আঁকড়ে ধরে একলা বাঁচতে শুরু
করলো। আমি একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“তালাকটা না দিলে কি বেঁচে থাকা খুব কষ্টের
হয়ে যেত?” মেয়েটি জবাব দিয়েছিল, “আমি তো
সহ্য করেই ছিলাম আপু। কিন্তু তুমি যখন নিজের
বরকে নিজের চোখে আরেকটি কাজের মেয়ের
সাথে সেক্স করতে, তুমি কি সেটা সহ্য করতে
পারবে?” এই প্রশ্নের জবাব হয় না। আমি আর কিছু
বলতে পারিনি।
কিছুদিন বাদেই এই মেয়েটি যখন দ্বিতীয়বার
বিয়ে করে সংসার পাততে চাইল, একজন অসম্ভব
হৃদয়বান পুরুষ সবকিছু জেনে শুনে বুঝে মেয়েটিকে
ভালোবেসে ফেলল আর বিয়ে করতে চাইল, তখন শুরু
হলো আরেক সিনেমা। মেয়ের মা বাবা
ছেলেটিকে কেটে টুকরো টুকরো করার হুমকি দেয়।
মেয়েটির প্রাক্তন শ্বশুর বাড়ি নানান রকমের
কুকথা মেয়েটির নামে রটায়।
এমনকি অফিসের সহকর্মীরাও নানান রকম
ফিসফাস জোরেসোরে করে। সবকিছুর একটাই
সারমর্ম- “মেয়ে বেশ্যা। বেশ্যা না হলে কি
স্বামীকে তালাক দেয়? বেশ্যা না হলে কি মা
বাপের ঘর ছেড়ে আলাদা থাকে? বেশ্যা না হলে
কি আবার দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়?” কেউ একটি
বার ভেবেও দেখল না যে একটি একাকী
ডিভোর্সি মেয়েকে এই সমাজের তথাকথিত
পুরুষেরা কী ভয়ানক পরিমাণ নির্যাতন করে।
সকলেই তাঁকে ভোগের বস্তু মনে করে হাত বাড়ায়,
আর না পেলে রটনা রটায়। সেই পরিস্থিতি থেকে
বের হবার একমাত্র উপায় মেয়েটির পাশে একজন
যোগ্য বর।
একটি মেয়ে, যে দাম্পত্য জীবনের অন্যায়ের
বিরদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছে, নিজের
জীবনটাকে গুছিয়ে নেবার জেদ করেছে,
একটুখানি সুখী হতে চেয়েছে জীবনে, সেই
মেয়েটিকে কি অনায়াসে আমরা ট্যাগ দিয়ে
দিলাম “বেশ্যা”। একদিন সেই মেয়েটির শাশুড়ি
আমাকে ফোন করেছিলেন, মেয়েটির নামের
জায়গায় সম্বোধন করছিলেন “ওই বেশ্যাটা”! আমি
শুধু আস্তে করে বলেছিলাম-“বেশ্যাই যখন হবে,
তাহলে ওই মেয়ের কাছ থেকে তালাক পেয়ে
আপনার ছেলে এত অস্থির হচ্ছে কেন?”
[এই সবই বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। এতদিন পর
আবার টেনে আনলাম প্রসঙ্গটি একটি সুসংবাদ
জানাতে। সেই ভীষণ জেদী আর লড়াকু মেয়েটির
সংবাদ জানাতে। হ্যাঁ, সাড়া পৃথিবীর বিরুদ্ধে
গিয়ে মেয়েটি বিয়ে করেছে সেই হৃদয়বান
পুরুষটিকে। তাঁদের বিয়ের বেস কয়েক বছর
পেরিয়েও গেছে। না, মেয়েটির পরিবার মেনে
নেয়নি। ছেলেটির পরিবারও নেয়নি, কেবল
ছেলেটির পিতা-মাতা ছাড়া। আর আজ তাঁদের ঘর
আলো করে সন্তান জন্ম নিয়েছে। একটি ফুটফুটে
ছেলে। মেয়েটির এখন সব আছে। একজন
ভালোবাসার মানুষ, এক টুকরো শান্তির সংসার,
একটি ছোট্ট সন্তান। আছে, কারণ মেয়েটি জেদ
করেছিল। বেঁচে থাকার জেদ]।

0 comments:

Post a Comment